ফরিদা আক্তার পপি (ববিতা নামে পরিচিতা) বাংলাদেশের একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী এবং প্রযোজক। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ৭০-৮০-র দশকের অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত
চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রশংসিত হন। ববিতা ২৫০
এর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তিনি পরপর তিন বছর একটানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন।
প্রাথমিক জীবন
ফরিদা আক্তার পপি ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায়
জন্ম নেন। তাঁর বাবা নিজামুদ্দীন আতাউব একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন এবং
মাতা বি. জে. আরা ছিলেন একজন চিকিৎসক। বাবার চাকরি সূত্রে তারা তখন
বাগেরহাটে থাকতেন। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলায়। শৈশব এবং কৈশোরের প্রথমার্ধ কেটেছে যশোর শহরের সার্কিট হাউজের সামনে রাবেয়া মঞ্জিলে। তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়বোন সুচন্দা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, বড়ভাই শহীদুল ইসলাম ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মেজভাই ইকবাল ইসলাম বৈমানিক, ছোটবোন গুলশান আখতার চম্পা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী এবং ছোটভাই ফেরদৌস ইসলাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। এছাড়াও অভিনেতা ওমর সানী তাঁর ভাগ্নে এবং অভিনেত্রী মৌসুমী তাঁর ভাগ্নে বউ (ওমর সানীর স্ত্রী) এবং অভিনেতা রিয়াজ তাঁর চাচাত ভাই। চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তার ভগ্নিপতি। ববিতার পরিবার একসময় বাগেরহাট থেকে ঢাকার গেন্ডারিয়াতে চলে আসে। তাঁর মা ডাক্তার থাকায়, ববিতা চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে। ববিতার একমাত্র ছেলে অনীক কানাডায় পড়াশোনা করেন, তাই তিনি ২০১০ সালের মাঝামাঝিতে প্রায় ছয় মাস কানাডায় অবস্থান করেন।
শিক্ষাজীবন
তিনি পড়াশোনা করেছেন যশোর দাউদ পাবলিক বিদ্যালয়ে। সেখানে অধ্যয়নকোলে
বড়বোন কোহিনুর আক্তার চাটনীর (সুচন্দা) চলচ্চিত্রে প্রবেশের সূত্রে পরিবার
সহ চলে আসেন ঢাকায়। গেন্ডারিয়ার বাড়ীতে শুরু হয় কৈশরের অবশিষ্টাংশ।
চলচ্চিত্রে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট অর্জন না
করলেও ববিতা ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। দক্ষতা অর্জন করেন
ইংরেজিসহ কয়েকটি বিদেশী ভাষায়। নিজেকে পরিমার্জিত করে তোলেন একজন আদর্শ
শিল্পীর মাত্রায়।
কর্মজীবন
তার চলচ্চিত্র কর্মজীবনে আসার পেছনে বড়বোন সুচন্দার অনুপ্রেরনায় রয়েছে। বড়বোন সুচন্দা অভিনীত জহির রায়হানের সংসার চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে। এই চলচ্চিত্রে তিনি রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রাথমিক নাম ছিলো "সুবর্ণা"। তিনি কলম নামের একটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলেন সে সময়। জহির রায়হানের জ্বলতে সুরুজ কি নিচে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই তাঁর নাম "ববিতা" হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রথম নায়িকা চরিত্রে। ১৯৬৯ সালের ১৪ই আগস্টে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় এবং ঐদিন তাঁর মা মারা যান। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে ভগ্নিপতি জহির রায়হানের
পথ প্রদর্শনে চললেও পরে তিনি একাই পথ চলেছেন। ৭০'-এর দশকে শুধুমাত্র
অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি গোটা দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে
প্রতিষ্ঠা করেন।
অভিনয় জীবন
ববিতা প্রায় তিন দশক ধরে চলচ্চিত্রে
অভিনয় করছেন। তবে এক পর্যায়ে সিনেমার জগতে টিকে থাকার জন্য এবং
বাণিজ্যিক ছবিতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের জন্য তিনি পুরোপুরি বাণিজ্যিক
ঘরানার ছবির দিকে ঝুঁকে পড়েন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তাই ববিতা একটি
উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। নায়িকা হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্যতা লক্ষণীয় ছিল।
অভিনয়, গ্ল্যামার, স্কিন পার্সোনালিটি, নৃত্য কুশলতা সবকিছুতেই তিনি
পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ববিতা মুটিয়ে যেতে
থাকেন এবং গৎ বাঁধা চলচ্চিত্রে এমন ভাবে অভিনয় করেন যে তাকে আলাদাভাবে
চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে। বর্তমানে তিনি মা-ভাবির চরিত্রে অভিনয় করে আসছেন।
প্রতিষ্ঠা
গ্রামীণ,শহুরে চরিত্র কিংবা সামাজিক অ্যাকশন অথবা পোশাকী সব ধরনের
ছবিতেই তিনি সাবলীলভাবে অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়
এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন।তৎকালীন সময়ে
তিনি ফ্যাশনের ক্ষেত্রে শহরের মেয়েদের ভীষণ প্রভাবিত করেন। নগর জীবনের
আভিজাত্য তার অভিনয়ে ধরা পড়েছিল। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে রুচিশীল,
সামাজিক সিনেমা মানেই ছিল ববিতা। ‘টাকা আনা পাই’
সিনেমাটা ছিল তাঁর জন্য টার্নিং পয়েন্ট যা পরিচালনা করেছিলেন জহির
রায়হান। এরপর তিনি নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’ সিনেমাতে অভিনয় করেন যা ছিল
সুপারহিট সিনেমা।
অশনী সংকেত
মূল নিবন্ধ: অশনি সংকেত (চলচ্চিত্র)
ববিতার চলচ্চিত্র কর্মজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অশনি সংকেত (১৯৭৩)। এই চলচ্চিত্রে "অনঙ্গ বৌ" চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন এবং ব্যপক প্রশংসিত হন। ১৯৯৩ সালে ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরষ্কার, ১৯৭৩ সালে
ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি পুরষ্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র
পরিচালক সমিতি কর্তৃক বিশেষ পুরষ্কার অর্জন করেন।
তেতাল্লিশের মন্বন্তর এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ বাংলার আর্থ-সামাজিক
পটপরিবর্তন ছিলো এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়। চলচ্চিত্রের প্রাককালে সত্যজিত
রায়ের নির্দেশে ভারতীয় চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ স্বাধীনতার পর ঢাকায় এফডিসিতে
আসেন, এবং সেখানে ববিতার প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ আলোকচিত্র তুলেন। এর কিছুদিন
পর ববিতার বাসায় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে একটি চিঠি আসে, প্রাথমিক
মনোনয়ণের কথা জানিয়ে। এরপর ববিতা এবং তার বোন সুচন্দা
ভারতে যান সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করতে। সত্যজিত ববিতাকে দেখে প্রথমে
অনেক লাজুক ভেবেছিলেন। তাই ইন্দ্রপুরের স্টুডিওতে তিনি তাঁকে আবার নানারকম
পরীক্ষা করেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সত্যজিত বলেন, "আমি অনেক খুশি,
আমি "অনঙ্গ বউ" আজকে পেয়ে গেছি। আমি ভাবতেও পারিনি এই মেয়েটি সেদিনের
সেই মেয়েটি। আজকে এই মেয়ে সম্পূর্ণ অন্য মেয়ে। এই আমার অনঙ্গ বউ।"
ববিতাও অনেক চাপের মুখে ছিলেন তাঁকে নেয়া হয় কিনা এ ব্যপারে। তিনি বলেন,
"একজন অল্পবয়সী বাঙালী যা করে, ভেতরে-ভেতরে অনেক মানত-টানত করে শেষে
জানলাম, আমি তাঁর ছবির জন্যে নির্বাচিত হয়েছি।"
চলচ্চিত্র তালিকা
সংসার - (১৯৬৮), শেষ পর্যন্ত -
(১৯৬৯) ,অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী - (১৯৭২) , আলোর মিছিল, বাঁদী থেকে বেগম, ডুমুরের
ফুল, বসুন্ধরা, গোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমনি, সুন্দরী, অনন্ত প্রেম, লাঠিয়াল, এক
মুঠো ভাত, আকাঙ্খা, মা, ফকির মজনু শাহ, সূর্য গ্রহণ, এখনই সময়, কসাই, জন্ম থেকে
জ্বলছি, বড় বাড়ির মেয়ে, পেনশন, দহন, চন্ডীদাস ও রজকিনী, দিপু নাম্বার টু, অশনি
সংকেত (১৯৭৩), রামের সুমতি (১৯৮৫), নিশান, মন্টু আমার নাম, নাগ-নাগিনী, দোস্তী, প্রতিজ্ঞা,
বাগদাদের চোর, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, প্রতিহিংসা, নাগ পূর্ণিমা, চ্যালেঞ্জ, হাইজ্যাক, মায়ের
জন্য পাগল, টাকা আনা পাই, স্বরলিপি, তিনকন্যা, লটারী, শ্বশুরবাড়ি, মিস লংকা, জীবন
পরীক্ষা, জীবন সংসার, লাইলি মজনু, সাক্ষী।
পুরস্কার এবং সন্মাননা
ববিতা পরপর তিন বছর একটানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন। সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত
চলচ্চিত্র "অনঙ্গ বউ" চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি বেঙ্গল ফ্লিম
জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার পান।
এছাড়াও সরকারী এবং বেসরকারী অসংখ্য পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন। এজন্য তাঁকে
‘পুরস্কার কন্যা’ বলা হতো। তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সবচেয়ে
বেশিবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
বছর | চলচ্চিত্র | পুরস্কার | বিভাগ | ফলাফল |
---|---|---|---|---|
১৯৭২ | জহির রায়হান পদক | বিজয়ী | ||
১৯৭৩ | অশনি সংকেত | বেঙ্গল ফ্লিম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন | শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী | বিজয়ী |
১৯৭৪ | বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি | বিজয়ী | ||
১৯৭৫ | বাদী থেকে বেগম | জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার | শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী | বিজয়ী |
১৯৭৬ | নয়নমনি | জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার | শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী | বিজয়ী |
১৯৭৭ | বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি | বিজয়ী | ||
বসুন্ধারা | জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার | শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী | বিজয়ী | |
১৯৮০ | বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি | বিজয়ী | ||
১৯৮৫ | বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি | বিজয়ী | ||
রামের সুমতি | জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার | শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী | বিজয়ী | |
১৯৮৯ | এরশাদ পদক | বিজয়ী | ||
১৯৯৩ | অশনি সংকেত | বাংলা চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি | বিজয়ী | |
১৯৯৬ | পোকামাকড়ের ঘর বসতি | জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার | শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী | বিজয়ী |
- | অশনি সংকেত | বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি | বিশেষ পুরষ্কার | বিজয়ী |
সমালোচনা
মার্চ, ১৯৭৭ সালে মুক্তি প্রাপ্ত অনন্ত প্রেম
চলচ্চিত্রে শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক-ববিতার গভীর চুম্বনের একটি দৃশ্য ছিলো যা
সেই সময়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল। তবে চুম্বনের দৃশ্য বাদ দিয়েই
চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেয়া হয়। ৩৭ বছর আগে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটির
জন্যই চিত্রায়িত হয়েছিল বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের প্রথম চুম্বন দৃশ্য।
0 comments:
Post a Comment